বাংলা উপন্যাসঃ সম ভালোবাসা ২য় পর্ব

২। দূরদেশে
প্রশস্ত নদীর উপর জোয়ারের পানি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার যেন আর বয়ে যাওয়ার তাড়া নেই। একটা পানকৌড়ি ঊড়ে গেল। আকাশে কিছুক্ষণ চক্কর দিল। চোখ তার পানির উপর। কিছু একটা খুঁজছে। তারপর ঝপাস করে পানির বুকে ডুব মারল। অনেকক্ষণ পর ভূস করে ভেসে উঠল। ঠোঁটে’র ডগায় একটা কৈ মাছ। সে ঘাটের মানুষগুলোর দিকে একবার ঘাঁড় ঘুরিয়ে দেখে আবার ডানা ঝাপটে আকাশে ঊড়াল দিল। ঘাটে মানুষের কোলাহল শোনা যাচ্ছে। নদীর তীরে কাঠের মাচা করে ঘাট বানানো হয়েছে। ঘাটটা নদীর বেশ ভিতরে নেমে এসেছে। ঘাট সরদার ফয়জুদ্দি একটা টুলের উপর বসে ক্যাশ বাক্সটার উপর মাথা রেখে ঝুমুচ্ছিল। গায়ে তার না ফতুয়া না পাঞ্জাবী টাইপের একটা জামা গায়। দুপুর গড়িয়ে গেছে। বোয়াল মাছের পেটি দিয়ে ঠেসে ভাত খেয়ে মুখে একটা পান পুরে চিবোতে চিবোতে ঘাটে এসে বসেছে। বিকেলের জাহাজ আসার সময় হয়ে গেছে। চোখে ভাতঘুম। একটু গড়িয়ে নিতে পারলে মন্দ হত না। পাশে বসে রাঙা বউ বাতাস করত। তা হবার কি আর জোগার আছে। ইংরেজ রাজত্বে হিদুগো রাম-রাজত্বি। যত ভোগান্তি সব মোচলমানের কপালে। এইবার অনেক কষ্টে চেষ্টা তদবির করে সাহাবাড়ীর নীলু সাহাকে হারায়ে সে ঘাটের নিলাম নিতে পেরেছে। ঘাটটা টেন্ডার নেবার পর তার সংসারে অনেকটা স্বচ্ছলতা এসেছে। বড় বউ পায়ের বেদনায় বছরে ছয় মাস কাতরায়। সামান্য চাপ লাগলি আহ-উহ শুরু করে। মন ভরে আর মউজ করার উপায় কই। তাই গেল বর্ষায় সে সলিম মাঝির রাঙা মাইয়াটারে নিকে করে ঘরে তুলেছে। বয়সে তার বড় মাইয়াটার থেকে বছর দুয়েক ছোট হবে। তাতে এমন কি হয়েছে। পুরুষ মানুষের আবার বয়স কি!

জাহাজের শব্দে সে চোখ মেলল। যদিও এটা জাহাজ না। ট্রলার আর লঞ্চের মিশ্র রুপ এই জাহাজ। তিন ক্রোশ দূরের রেল স্টেশন থেকে মানুষ আনা নেয়া করে এই জলযান। দিনে দুইবার আসে, দুইবার যায়। একবার সকালে আর একবার বিকেলে। জাহাজের শব্দে আধা উলংগ বাচ্চাগুলো ঘাটের উপর ছুটে গেল। প্রতিদিন দুইবার করে জাহাজ দেখে তবু যেন এদের দেখার স্বাদ মেটে না। ফয়জুদ্দি গলা চড়ায়, “ঐ ইবলিশের দল, গেলি। দূর হ সব এখান থেকে। পানিতে পড়ে ডুবে মরলে সব ফ্যাঁকড়া আমার ঘাড়ে এসে চাপব।” যদিও এরা পানিতে ডুবে মরে না। পানি এদের ডোবাতে পারে না। শোলার মত ভেষে থাকে। জন্মেই তো এরা পানিতে নেমে ঝাঁপাঝাপি করা শুরু করে।

জন ভারতবর্ষে এসেছে মাস দুয়েক হল। এতদিন সে কলকাতায় ছিল। বন্দুক চালানো, নেটিভ ভাষা শেখা এসব নিয়ে খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছিল। নিজের দিকে তাকানোর ফুরসত পায়নি।তাকে পোস্টিং দেয়া হয়েছে এই ভারতবর্ষের বাঙ্গালা নামের এক প্রদেশে। সুন্দরবনের ওদিকে কোথায় যেন অবস্থিত। সেখানকার যশোহর নামক এক জায়গায় তাকে ইংরেজ রাজত্বের দেখভাল করতে হবে। টমসন সাহেব সেখানকার বড় কর্তা। মহকুমা সদরে তার আস্তানা। বাঙালীরা ইদানীং খুব চালাক হয়ে ঊঠেছে। সুযোগ পেলেই সরকার বাহাদুরকে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করে। মহারাণী ভিক্টোরিয়ার রাজত্বে তো তোরা সুখেই আছিস। সময় মত খাজনা দিলেই তো সব ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু না, বাবুয়ানা করার বেলায় বাঙালীর পাউন্ডের অভার হয় না, খাজনা দেবার বেলায় নেই হুজুর স্বভাব। পাউন্ড না, বাঙালী মুদ্রার নাম কি যেন? রুপি নাহ! এরা কারেন্সিকে টাকা বলে।

gay bangladesh

জাহাজে একগাদা নেটিভ বাঙালীর মাঝে বসে জন এসব হিজিবিজি ভাবনায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল। চারপাশে দেখার মত সে কিছু খূঁজে পায়নি। অবশেষে ঘাট এল। মনে হচ্ছিল সে কয়েক শতাব্দী ধরে এই জাহাজে আছে। পথের যেন শেষ নেই। ভটভট শব্দটা মাথায় এমনভাবে জেকে বসেছে যে মাথাটা পাথরের মত ভার লাগছে। এখন অনায়াসে এটাকে রকস মিউজিয়ামে রেখে দেয়া যায়। জাহাজে ওঠার সময় যে ঝামেলা হল এখন নামার সময় সেই একই ঝামেলা। বাঙালীরা যেন সবাই একসাথে নামতে চায়। না নামতে পারলে হয়তো জাহাজ এদের না নামিয়েই ফিরে যাবে। জাহাজের খালাসিরা জনের বাক্স পেটরা নামিয়ে দিল ঘাটের উপর। সাদা চামড়ার সাহেব দেখে ফয়জুদ্দি খাতির করে ছুটে এল। বাংলা হিন্দী উর্দু ফারসি আর ইংরেজীর মিক্সারে তৈরী বিচিত্র ভাষায় সে ভাব জমানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সে বাংলায় আঞ্চলিক, হিন্দীতে স্বশিক্ষিত, উর্দুতে দুর্বল, ফারসিতে অনভিজ্ঞ আর ইংরেজীর হাতে গোনা কয়েকটা শব্দ জানে, হ্যালো, থ্যাংকু আর গুড বাই। জন কলকাতায় থাকাকালীন কিছু নেটিভ বাংলা শিখেছে। কিন্তু এখানকার কথার টান সম্পূর্ণ আলাদা। ফয়জুদ্দির আবার ঘাটের টাকা আদায় না করলে নয়। সে ফিরে গেল তার ক্যাশ বাক্সটার কাছে।

মন্তব্য করুন