প্রতিশোধ – Nill Megh

গত তিনমাস ধরে আমার মনে একটুও শান্তি নাই।প্রতিশোধের আগুনে যে মানুষ কিভাবে পুড়ে তা এখন আমি হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি।প্রতিরাতে আমার ঘুম আসেনা,জহির আমার সাথে কেমনে এমন করতে পারল।এতদিনের সম্পর্ক অচেনা একটা মেয়েকে বিয়ে করে কেমনে শেষ করে দিতে পারে?
না আমি এত সহজে ছাড়বনা,আমি যে আগুনে অহর্নিশি পুড়ে যাচ্ছি তাকেও সেই আগুনে না পুড়ানো পর্যন্ত আমার শান্তি নাই।

আমি আর জহির সস্তা একটা রেস্টুরেন্টে বসে চা খাচ্ছি।চারদিকে মানুষ গিজগিজ করছে।হঠাৎ জহির বলল এই দেখত আমার গালে কি লাগছে?
কই কিছু নাতো
-আরে কাছে এসে দেখ
আমি ওর গালের কাছে যাওয়ার সাথে সাথে কিছু বুঝার আগেই সে সরে এসে ওর গাল আমার মুখে লাগাল।আমার নাক আর ঠোঁটের ছোঁয়া ওর গালে লাগল।ব্যাপারটা এত অকস্মাৎ হল যে কেউ বুঝলই না জহির আমার কাছ থেকে কত সুন্দর করে কিস নিয়ে নিল।প্রথম প্রথম আমিও বুঝতাম না।ওরে জিজ্ঞাসা করতাম,কি ব্যাপার এটা কি হল?

-আরে তুমিতো সবার সামনে আমাকে চুমু দিতে পারবেনা তাই বুদ্ধি করে এই উপায় বের করলাম।
এই সেই মানুষ যার সাথে আমি গত ২বছরে ৭৩০দিনের মধ্যে ৭০০দিনই দেখা করেছি।একদিন দেখা না করলে তার ছেলেমানুষি শুরু হত।দেখা যেত আমাদের বাসার নিচে এসে আমাকে ফোন দিত।আমাকে না দেখা পর্যন্ত নাকি সে নিঃশ্বাস নিতে পারেনা।
কেমন করে আমি তাকে ভুলি?
আমি যে অন্তরজ্বালায় পুড়ছি তাকে সেই জ্বালায় না পুড়ানো পর্যন্ত আমার শান্তি নাই।
আমার বান্ধবী তামান্না,এক সাথে একই পাড়ায় আমরা বড় হয়েছি।বড়লোক বাপের আহ্লাদী কন্যা বলতে যা বুঝায় সে তাই।বিপাশা বাসুর ফ্যান,শুধু ফ্যান না বেতালা ফ্যান যারে বলে সে হচ্ছে তা।
আপাতত আমার মাথায় যে বুদ্ধি এসেছে সেটা ওরে দিয়েই করাতে হবে।আজকে ওদের বাসায় গেলাম।
ওরে বললাম,”জোড়ি ব্রেকার” দেখেছিস?
-হ্যাঁ দেখেছি,কেন?
ওই সিনেমায় বিপাশা যা করত তা করতে পারবি?
-কি করব?তোরে কিস করতে হবে?
ধুর ধুমসি,কিস না।ওই মুভিতে বিপাশার যে প্রফেশন ছিল সেটা করতে বলছি।
-সংসার ভাঙ্গা?
হ্যাঁ
-কি বলিস।আমি পারবনা।এটা ঠিকও হবেনা।
আমি দেখলাম সে মুখে না করছে কিন্তু তার চোখেমুখে স্পষ্ট নতুন কিছু একটা করার অ্যাডভেঞ্চার ফুটে উঠেছে।
ওরে দ্বিতীয় ডোজ দিলাম।বললাম আমার এক ভাইয়া বুঝলি,জোর করে তার পরিবার তাকে তার অপছন্দের মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।এখন সে কিছুতেই ওই মেয়ের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছেনা।আবার তার পরিবার তাকে ডিভোর্সও দিতে দিবেনা আর যদি সে দেয়ও তাইলে তাকে মোটা অঙ্কের মোহরানার টাকা শোধ করে তবেই ডিভোর্স দিতে হবে।এমতাবস্থায় ওই মেয়ে যদি তাকে ডিভোর্স দেয় তাইলে তাকে কোন টাকা দিতে হবেনা।
তুই প্লিজ লোকটারে বাঁচা।
-না বাবা আমি পারবনা।
ওর ভাব ধরা দেখে ভেতরে ভেতরে আমার গাঁ জ্বলে যাচ্ছে।
এবার ওরে ফাইনাল ডোজ দিলাম।বললাম তুই যদি কাজটা করে দিতে পারিস তাইলে তোর সাথে বাজি ধরলাম তোকে চাইনিজ খাওয়ামু।আমি খেয়াল করে দেখেছি বেশিরভাগ বড়লোকের ছেলেমেয়েরা বাজির নামে ক্রেজি।এরা ৫টাকার সিঙ্গারার জন্য ৫০০টাকার বিপদজনক বাজি ধরতেও রাজি হয়ে যায়।তামান্নাও এদের দলের।
সে রাজি হল,শুধু রাজি না যথেষ্ট উৎসাহের সাথেই রাজি হল।
আমি ওরে জহিরের বউয়ের মোবাইল নাম্বার দিয়ে সবকিছু বুঝিয়ে চলে আসলাম।
আজ তিনদিন হয়েগেল তামান্নাকে একটা ফোন দিয়ে জানতে হবে কতদূর কি করল।আনমনা হয়ে ছাদে হাঁটছি।

এই ছাদের কোণায় কোণায় জহিরের স্মৃতি মেখে আছে।বাসার কেউ না থাকলেই আমি জহিরকে ফোন দিতাম,সাথে সাথেই জহির চলে আসত।শুরু হত খোলা আকাশের নীচে দুই যুবকের আদিম খেলা।কত বিকেলকে যে সুখের সাগরে ভাসিয়ে আমরা সন্ধ্যা পর্যন্ত নিয়ে গেছি।আমাদের মাথার উপর চিলরা তারস্বরে চিঁ চিঁ করছে,হয়তো দুই যুবকের নগ্ন দেহ দেখে ওরা আতঙ্কিত।
হঠাৎ তামান্নার কথায় বাস্তবে ফিরে এলাম।
-কিরে তুই এখানে,আমি সারা বাড়ি খুঁজছি।
ওর মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝলাম ওই ধুমসি বেতালা ক্রেজি ফ্যান কিছুই করতে পারেনি।ওরে জিজ্ঞাসা করলাম,তোর কাজের খবর কি বল?
-খবর ভাল না রে দোস্ত।ওই বেটি আস্ত একটা কচ্ছপ।জামাইরে এমন কামড় মাইরা ধরছে যে ছাড়ানোই যাচ্ছেনা।
ওহ তাইলে তুই ব্যর্থ?
-আরে না,আমার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি এসেছে।
কি?
-আমরা ওই কচ্ছপ বেটিরে এমন ভয় দেখাব যাতে জামাইতো ছাড়বে ছাড়বে আর জীবনেও বিয়ের নাম নিবেনা।
কিরকম ভয়?
-আমার পরিচিত এক লোক আছে যে ভাড়ায় কাজ করে দেয়।
ভাড়ায় কাজ করে দেয় মানে?
-আরে গাধা সে ভাড়াটে মাস্তান,আমরা তারে দিয়া ওই মেয়েরে ভয় দেখামু।
না না সেটা ঠিক হবেনা।
-ধুর গাধা সে তো ওর কোন ক্ষতি করবেনা।জাস্ট ভয় দেখিয়ে বলবে যে,সে যদি ওই স্বামীর ঘরে থাকে তাইলে তাকে মেরে ফেলবে।
প্রতিহিংসার হোক আর প্রতিশোধের অনলে হোক আমি এতটাই অন্ধ হয়েছি যে তামান্নার এই ভয়ঙ্কর প্রস্তাবেও আমি রাজি হয়ে গেলাম।আমার বারবার মনেহল জহির কেন একা সুখে থাকবে আমাকে কাঁদিয়ে।
তামান্না বলল,ওর ফিস ৫হাজার টাকা।
এত টাকা আমি কোথায় পাব?
-তুই পাবে মানে?যার কাজ সে দিবে,তুই দিবি কেন?
নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেরই রাগ হল,বুঝলাম কথাবার্তায় আমাকে আরও সতর্ক হতে হবে।
না ভাইয়াই দিবে বলে কথা ঘুরানোর জন্য ওরে বললাম তুই এতসব জানিস কেমনে?
-আরে রিতারেতো ওই জাহাঙ্গীরকে দিয়েইতো আমি সাইজ করিয়েছি।
তুইইইইইইইইইইইই?
-হ্যাঁ,আমি।কাউরে বলিসনা দোস্ত।
এই মেয়েটাকে মনেহল আজকে আমি আবার নতুন করে চিনছি।নারীর মন স্বয়ং ঈশ্বরও বুঝেননা,আসলেই ঠিক।ঈশ্বর যদি কোনমতে বুঝতেও পারেন আমরা কোনদিনও বুঝতে পারবনা।
জাহাঙ্গীরের সাথে সব কথাবার্তা তামান্নাই বলল।আমাকে পরদিন দুপুরে একটা সিডির দোকানে গিয়া ঠিকানা আর ছবি দিয়ে আসতে হবে সাথে ৫হাজার টাকা।
আমি জহিরের ফেসবুক আইডি থেকে ওর বউয়ের ২/৩টা ছবি ডাঊনলোড করে পরদিন সময়মত ওই দোকানে গেলাম।
জাহাঙ্গীর সাহেবকে যেরকম দেখব ভাবছিলাম দেখতে মোঠেও সেরকম না।লম্বা চুলের কেমন একটা কবি কবি ভাব আছে চেহারায়।তবে কথা বলে বুঝলাম চোখের দেখাই সব না।তার মাঝে ভয় দেখানোর মতো ব্যক্তিত্ব আছে।তাছাড়া রিতা যদি ভয় পেয়ে থাকে তাইলে জহিরের বউ কোন মহাভারত।
বারবার করে বলে দিলাম শুধু ভয় দেখাবেন আর কিছুনা।
এক কথা বারবার বলায় উনি যে খুবই বিরক্ত সেটাও গোপন রাখলেন না।
আমি টাকা আর ছবি দিয়ে চলে আসলাম।
২দিন পর খবর পেলাম মিশন জাহাঙ্গীর ব্যর্থ হয়েছে,শুধু যে ব্যর্থ তা না চরমভাবে ব্যর্থ।
এই মহান ভয়করের(জাদু দেখালে যদি জাদুকর বলা হয় তবে যারা ভয় দেখায় তাদের নিশ্চয় ভয়কর বলা যাবে)চোখ নাকি জহিরের বউয়ের গলার হাঁরের দিকে চলে গিয়েছিল আর উনি ভয় না দেখিয়েই হাঁর নিতেই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন।
উনি মনেহয় এই লাইনে বেশি পুরাতন না তাই তাইতো সামান্য একটা হাঁর উনার আনাড়ি হাত ধরার আগেই জহিরের বউয়ের চিৎকারে এলাকার লোকজন জড়ো হয়ে ওদের হালকা ধুলাই খেয়ে কোনমতে পালিয়ে এসেছেন।যদি পুলিশে পেত তাইলে কি হত ভাবতেই গাঁ শিউরে উঠছে।নির্ঘাত রিমান্ডে গিয়া আমার নাম বলত।এইজন্য গুরুজনরা বলেন মেয়েদের বুদ্ধি না নিতে।আমিও প্রতিজ্ঞা করলাম আর কোনদিন মেয়েদের বুদ্ধি নেবনা।

রাতে আমার কষ্ট সব থেকে বেশি হয়।দিনে যেমন তেমন তাকে ভুলে থাকা যায় কাজের চাপে কিন্তু রাতে পারা যায়না।একেকটা রাত আমার কাছে মনেহয় একেকটা বছর।ওর সাথে কাটানো রাতের স্মৃতিগুলো মনে পরে যায়।কত রাত যে ওর বুকে শুয়ে পার করেছি।সেই রাতগুলোতে মনেহত সূর্য তার মুখ দেখানোর জন্য বড় তাড়াহুড়ো করছে তাইতো এত তাড়াতাড়ি ভোর হয়ে যায়।আর এখন মনেহয় চাঁদ-তাঁরা ষড়যন্ত্র করছে যাতে সূর্য দেরিতে আসতে পারে তাইতো রাতগুলা এত দীর্ঘ আর ভয়ানক কষ্টকর হয়।
আর না,যা করার আমাকেই করতে হবে।প্রতিশোধের আগুনে আমি দাউদাউ করে জ্বলছি।
আমি একাএকা জ্বলব আর জহির বউ নিয়ে সুখে থাকবে এটা হতে পারেনা।ওই সংসারে আমি আগুন লাগাবই।
আমি জহিরের বউয়ের সাথে দেখা করব,ওরে সব খুলে বলব।দেখি সব জেনেশুনে সে কেমন করে সংসার করে।
জহির যে বউ নিয়ে একা থাকে সেটা আমি জানি,ওর মা বাবা গ্রামে থাকেন।

দরজা খুলে যে দিল তাকে দেখে আমার আর বুঝতে বাকি রইলনা সে কে।
সুশ্রী মায়াবী চেহারার একটি মেয়ে।এমনভাবে আমাকে ভেতরে এস বলল যে মনেহল সে আমার কত পরিচিত কত আপন।আশ্চর্য আমি এই মেয়েটিকে দেখে রাগে কিংবা ক্ষোভে যতটা ফেটে পড়ব ভেবেছিলাম তার সিকিভাগও হচ্ছেনা।
আমাকে বসিয়ে সে বলল,কেমন আছো শিমুল?
আমি অবাক সে আমার নাম জানে দেখে।
-জহির আমাকে বিয়ের রাতেই সবকিছু বলেছে,তোমার ছবিও দেখিয়েছে।তুমি না আসলে আমিই তোমার সাথে দেখা করতাম।
কেন?
-আমার স্বামী যাকে এত ভালবাসে তাকে একবার দেখার,তার সাথে কথা বলার খুব ইচ্ছা ছিল।
মানে?
-মানে জহির এখনও তোমাকে ভালবাসে।বাসর রাতে আমি জানিনা কোন মেয়ের তার স্বামীর চোখের জল দেখতে হয়েছে কিনা তার প্রাক্তন প্রেমিকের জন্য কিন্তু আমি দেখেছি।এটা যে একটা মেয়ের জন্য কত কষ্টের তা ওই মেয়েই জানে।
আইনে,সমাজে কিংবা শারীরিকভাবে আমরা স্বামীস্ত্রী কিন্তু মানসিকভাবে যে আমি তার স্ত্রী সেটা বিছানায় আমি তার মাঝে খুঁজে পাইনা।যেন দায়ভার থেকে কিছু করা।সে এখনও প্রতিনিয়ত পোড়ে দগ্ধ হচ্ছে।সাথে আমিও।
একটানা কথাগুলো বলে সে আবার বলতে শুরু করল।
তুমি আমার ভাইয়ের মত।আমি জানিনা আমাদের ভবিষ্যৎ কি।তোমাদের দুইজনের মাঝে আমাকে শুধু একটুখানি জায়গা দিয়ে দিও।আমার যে যাওয়ার কোন জায়গা নাই।
এসব কি হচ্ছে,আমি কি বলতে এসেছি আর হচ্ছে কি।আমিতো এতদিন জহিরকে কষ্ট দিতেই চাইছিলাম কিন্তু জহির এখন কষ্ট পাচ্ছে শুনে আমার কষ্ট হচ্ছে কেন?সবকিছু কেমন জানি উলটপালট হয়ে গেছে।
আমি ওই মেয়েকে বললাম,তুমি চিন্তা করনা বোন।জহির তোমার আছে তোমারই থাকবে।
ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম।
প্রতিহিংসায় আমি এতটাই হিংস্র হয়ে গেছিলাম যে আমার বিবেক বুদ্ধি লোপ পেয়ে গেছিল।ওই মেয়েটাতো কোন দোষ করেনি,সে তো আর জেনেশুনে জহিরকে বিয়ে করেনি।তাইলে সে কেন কষ্ট পাবে।
আর জহিরেরই বা দোষ কতটুকু।তার অসুস্থ মা যদি তাকে ইমোশনাল করে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয় তাইলে তার কতটুকুই বা করার আছে।সে তো আর আমাদের সম্পর্কের কথা বলতে পারবেনা,আমি নিজেই কি পরিবার সমাজ সব তুচ্ছ করে কাউকে বলতে পারতাম।
কেন আমার জন্য তাদের দাম্পত্য জীবন বিভীষিকাময় হবে।আর সে তো আমার চেয়ে আরও বেশি কষ্ট পাচ্ছে।আমাকেতো বিছানায় কারও সাথে অভিনয় করতে হচ্ছেনা কিন্তু তাকে তা করতে হচ্ছে।
সংসারের যাঁতাকলে পরে একদিন হয়তো জহির সব ভুলে যাবে আমিও সেটাই চাই।

আমি আর কোনদিন জহিরের মুখোমুখি হবনা।আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জহিরের কাছ থেকে দূরে যেতে হবে।

ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার আগে ভাইয়া তার ওখানে স্টাডির জন্য চলে যেতে বলেছিল কিন্তু তখন জহির ছিল বলে রাজি হইনি।
এখন ভাইয়াকে সব কাগজপত্র মেইল করে দিয়েছি ইংল্যান্ডের greenwich ভার্সিটিতে এডমিশনের জন্য।
লেখাপড়ায় দুইবছর পিছিয়ে পড়তে হবে আমায়,একটা সংসারের সুখের জন্য সেটা কিছুই না।

5 thoughts on “প্রতিশোধ – Nill Megh

  1. আমিও হয়ত এমন কিছুর সামনা হতে চলছি।ভাল লাগল।

    Like

মন্তব্য করুন