ছেলে বেলার ফেলে আসা কথা – ঝড়ো বাতাসের লেখা

মজার কথা বলি, ক্লাস সিক্সে ওঠার পর ভালো ছাত্রদের দেখাদেখি ক্যাডেট কলেজে ভর্তির জন্য কোচিং শুরু করলাম। ক্যাডেট কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় সাধারণ জ্ঞান অংশের জন্য বহুত কিছু পড়তে হতো; মন্ত্রীর নাম, দেশের নাম, শহর-বন্দরের নাম, টেকা-পয়সার নাম থেকে শুরু করে বিশ্বসুন্দরীদের নাম পর্যন্ত। বিশ্বসুন্দরী যে একখান প্রতিযোগীতা, দুনিয়ার তাবৎ সুন্দরীদের মিলনমেলা, সেই প্রথমই এই কথাটা জানতে পেরেছিলাম। মেয়েলি ছেলে ছিলাম, খুব স্বাভাবিকভাবেই সৌন্দর্য্য, সুন্দরীপ্রতিযোগীতা – এসব ব্যাপারেও আগ্রহ একটু বাড়াবাড়িরকমই ছিলো। মনে আছে, সেবার বিশ্বসুন্দরী হয়েছিলো নাইজেরিয়ার এক অষ্টাদশী, মিস আগবানি ডারেগো। বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগীতার ৫২ বছরের ইতিহাসে সেবারই প্রথম কোন কৃষ্ণাঙ্গ রমণী শিরোপা জিতেছিলো। তার ঠিক আগের বছর, অর্থাৎ দু’হাজার সালে বিশ্বসুন্দরী হয়েছিলো আমাদের চেনামুখ, পাশের বাড়ির প্রিয়াংকা, প্রিয়াংকা চোপড়া। লাস্যময়ী প্রিয়াংকা হাসিমুখে লজ্জাবনত আগবানির মাথায় রত্নখচিত মুকুট পড়িয়ে দিচ্ছে, প্রথম আলোর পাতা থেকে এই ছবিটা কেটে দীর্ঘদিন লুকিয়ে রেখেছিলাম নিজের কাছে, সবার নজর এড়িয়ে।

ভাবলে হাসি পায়, শুনলে আরো বেশি হাসি পাবে; সেই তখন, আমি নিজেকেও খুব সুন্দর ভাবতে শুরু করে দিয়েছিলাম। আচ্ছা, ঝেড়ে কাশছি। সুন্দরী ভাবতে শুরু করেছিলাম। আরো স্পষ্ট করে বললে, নিজেকে বিশ্বসুন্দরীর আসনে বসিয়ে কল্পনা করতাম। তখন তো আর ইন্টারনেট অতো সুলভ ছিলো না, খোঁজ খবর পাওয়াও অতটা সোজা ছিলো না। তবুও কষ্ট করে যেখানে যেটুকু পেতাম, খুঁজে খুঁজে পড়তাম। যেখানে যতটুকু তথ্য পাওয়া যায় সংগ্রহ করে রাখতাম; বিশ্বসুন্দরীদের সম্পর্কে, তাদের জীবনযাপন, রুপচর্চা, পছন্দ-অপছন্দ – সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মুখস্ত করতাম। কোন কবি কিংবা বিজ্ঞানী নয়, তখন বিশ্বসুন্দরীরাই ছিলো আমার আইডল। সুন্দরী নিয়ে এত আগ্রহ আর মাতামাতি দেখে এক কাছের বন্ধু আমায় নাম দিয়ে বসেছিলো ‪#‎Miss_world‬ . হাইস্কুলের ছেলে-পেলে যেমন হয়, নামটা ছড়িয়ে পড়তে মোটেও সময় লাগলো না। দেখা হলেই যেখানে-সেখানে ছেলেপেলে “মিস ওয়ার্ল্ড” বলে চেঁচাতো। সত্যি বলতে কি, আমার একটুও খারাপ লাগতো না
বরং ঐ একটা Bullying word আমার প্রিয়ই ছিলো বলা যায়।

সেই দিনও আর নেই, আমার মিস ওয়ার্ল্ড হওয়ার খায়েশও আর নেই। বন্ধুরাও এতদিনে বেমালুম ভুলে গেছে আমার সেই “উপাধি”
এটা বলতে খুব জ্ঞানী হওয়ার দরকার পড়ে না, পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য কিশোরী এবং সমকামী/মেয়েলি কিশোরদেরই এরকম স্বপ্ন থাকে; নায়িকা-মডেল-গায়িকা বা বিশ্বসুন্দরী হবার। সময়ের সাথে সাথে সেইসব স্বপ্ন ফিঁকেও হয়ে যায়। স্বপ্নবাজ, চঞ্চলমতি, কল্পপ্রবণেরা বাস্তবতার সামনে অসহায় হয়ে নিজেদের সুখস্বপ্নগুলো আপনি বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়।

কিন্তু সবাই স্বপ্নভুলো হয় না, কিছু সাহসী ব্যাতিক্রম মানুষও থাকে, যারা নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করে তবেই ছাড়ে। নিজের হাতে ভাগ্য গড়ে নিয়ে তবেই তারা ক্ষান্ত হয়। এমনই এক দুঃসাহসী, স্বপ্নবতী, আমাদের আদর্শ। আদর্শ এই বাংলাদেশেরই ছেলে, অন্য অনেকের মতো তারও স্বপ্ন ছিলো বিশ্বসুন্দরী হবার। তবে, অন্য সবার মতো কুটিল সমাজজীবন আর ক্রুর বাস্তবতার কাছে আত্মসমর্পণ করে বুকে লালন করা স্বপ্ন বিসর্জন দেয় নি সে। অপারেশনের মাধ্যমে নিজের সেক্স চেইঞ্জ করে নিয়ে এমেলিয়া মাল্টেপ নাম ধারণ করে এই সুন্দরী তরুণী তার স্বপ্নপূরণের পথে ইতিমধ্যেই অনেকদূর এগিয়ে গেছে। কানাডা প্রবাসী এই তরুণী এরই মধ্যে মডেলিংএও বেশ হইচই ফেলে দিয়েছেন। ভক্তও জুটিয়েছেন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে অসংখ্য। তার স্বপ্ন এবং ধ্যানজ্ঞান এখন বিশ্বসুন্দরী খেতাব জেতার।

জাতি হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, আমাদের স্বভাব কাঁকড়ার মতো। নিজেরা হতাশ-ব্যার্থ জীবন কাটাই আমরা আলসেমী ভরে, হঠাৎ আমাদের মধ্য থেকে দু’একটা স্ফুলিঙ্গ ঝলক দিলে, সবাই একসাথে ব্যাস্ত হয়ে পড়ি এক ফুঁ’য়ে তাকে নিভিয়ে দিতে, তার ঠ্যাং ধরে টেনে নিজেদের পর্যায়ে নামিয়ে আনতে। Amelia Maltepe, এই সাহসিনীকে আমরা এদেশে কোন সুযোগ দিতে পারি নি, নিজের পছন্দমতো জীবনযাপনের কোনরকম অধিকার দিতে পুরোপুরি ব্যার্থ হয়েছি। অথচ, এই মানুষটি যখন সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর ওপারে গিয়ে একান্তই নিজ প্রচেষ্টায় তার স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে চলেছে; আমরা, নিচু মানসিকতার বাঙ্গালীরা তাকে উৎসাহ দিতে না পারলেও, গালমন্দ করতে বিন্দুমাত্র পিছপা হচ্ছি না। ফেইসবুকে, ব্লগে – সবখানে যাচ্ছেতাই ভাষায় কুৎসিত গালাগালি করছে তাকে এই বাঙ্গালীর দল।
সমকামী-বিষমকামী-উভকামী এইসব বাদ দিয়ে যে কোন মানবতাবাদী, বিন্দুমাত্র বিবেকবোধ সম্পন্ন বাঙ্গালীর কাছে অনুরোধ, নিজের জীবনের অপ্রাপ্তি-হতাশার ঝাল যেনো আমরা অন্যের উপর না মিটাই। কাউকে উৎসাহ দেবার ক্ষমতা, কারো সাফল্য সহ্য করার ক্ষমতা যদি আমাদের নাই থাকে, তবুও যেনো নিজেদের বিচ্ছিরী জিভের ধারে অন্যকে ক্ষত-বিক্ষত না করি।

আর পারলে, যদি সাহসে কুলোয়, আমাদের ব্যাতিক্রমী মেয়েটিকে যেনো আমরা কিছুটা হলেও উৎসাহিত করি।
খুব বেশি কিছু করার দরকার নেই, তার ফেইসবুক পেইজে গিয়ে অন্তত একটু ভালোবাসার কথা জানিয়ে আসি, এবং বাংলাদেশীদের করা জঘন্য মন্তব্যগুলোর কিছুটা হলেও প্রতিবাদ করে আসি, এতেই যথেষ্ঠ মানবতা দেখানো হবে আমাদের।
‪#‎Amellia_Maltepe‬ এর জন্য অনেক অনেক শুভকামনা . প্রার্থনা করি, তুমিই হও পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বিশ্বসুন্দরী খেতাব জেতা Transsexual.

LGBT-ইতিহাসে তোমার নামের পাশাপাশি এই হতদরিদ্র-অশিক্ষিত-গোঁড়াপন্থী অভাগা দেশটির নামও শোভা পাক, মানবতাবাদী স্বপ্নবাজদের জন্মভূমি হিসেবে। বিশ্ব জানুক, বাঙ্গালী শুধুই বুকে ঘৃণাভরা মৌলবাদী না; জীবনসচেতন সাহসিকারাও এদেশে জন্মায়।

21 thoughts on “ছেলে বেলার ফেলে আসা কথা – ঝড়ো বাতাসের লেখা

  1. anur asthe amar besh mil ase. amio amar classmte ke love kori. or sathe jibon katate chai. kintu bolte pari na.

    Like

  2. সুন্দর। অনু আর রাজের কি প্রেম হবে?

    Like

  3. অনু আর রাজের বাসর এর গল্প শুনতে চাই।

    Like

  4. je kota golpo porlam, ekmatro etai different. gud story, lekhar man o valo…valo lagse,thnks to writer. bt at d mean tym i’m confused abt its future line up, is it gonna be dirty gay sex story??? i hope,nope, itz gonna be a reall story, story of lives

    Like

  5. Khub sundar galpo. Lekhaker dakhata o prasansoniyo. galpo ta parte parte college life er katha mone para jay. galper kendriyo charitro ersathe nijer mil khuje pai. thanx.

    Like

মন্তব্য করুন